পরিচিতিঃ কৃমি । কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার এবং প্রতিরোধ
কৃমির নাম শোনেন নি বা কৃমির সমস্যায় ভোগেননি এমন ব্যাক্তি বোধহয়
পৃথিবীতে নেই। ইংরেজিতে একে Stomach Worm বা Worm বলে। কৃমি মানুষের সবচেয়ে
ক্ষতিকর পরজীবি। ছোট বড় সবাই কৃমির দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। তবে শিশুদের
এ সমস্যায় বেশি ভুগতে দেখা যায়।
বাংলাদেশের জলবায়ু এই কৃমির সমস্যার বৃদ্ধির জন্য একেবারে উপযুক্ত। আমাদের আজকের
আর্টিকেলের আলোচ্য বিষয় কৃমি। আজকের পোস্টে আমরা জানব, কৃমি কি, কৃমির লক্ষণ,
কারণ, প্রতিকার এবং প্রতিরোধ সম্পর্কে। আশা করি পুরো পোস্টটি মনোযোগ সহকারে
পড়বেন।
কৃমি কি?
কৃমি একপ্রকার অমেরুদন্ডি পরজীবি যা মূলত মানুষের অন্ত্রে বাস করে এবং
মানুষের শরীর থেকে খাদ্য ও পুষ্টি গ্রহণ করে। কৃমি কেবল মানূষ নয়, যেকোন
প্রানীর শরীরেই বাসা বাধতে পারে।
কৃমি মূলত মানুষের অন্ত্রে বাস করলেও কিছু ক্ষেত্রে যকৃত, ফুসফুস এমনকি বিরল কিছু
ক্ষেত্রে চোখ এবং
মস্তিষ্কেও
হতে পারে। বাংলাদেশে যেসব কৃমি পাওয়া যায় সেগুলো নিম্নরূপঃ-
১. কেঁচো বাগোলকৃমি
(round worm)
২. বক্র কৃমি (hook worm)
৩. ফিতা কৃমি (Tape worm)
৪.চাবুককৃমি
(whip worm)
৫.গুড়া কৃমি( pin worm) বা সুতাকৃমি
(thread worm)
কৃমির কারণ
কৃমি বিভিন্ন ভাবে মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। তবে প্রধানত নিম্নলিখিত
ভাবে কৃমির সংক্রমণ হতে পারেঃ
১. দূষিত পানি এবং খাবারঃ
কৃমির ডিম এবং লার্ভা আক্রান্ত মানুষ এবং প্রানীর মলের মাধ্যমে পানি এবং
খাবারকে দূষিত করে। এই দূষিত পানি এবং খাবার গ্রহনের মাধ্যমে সুস্থ মানুষ কৃমিতে আক্রান্ত হতে পারে।
২. মাটি থেকেঃ
কৃমির ডিম এবং লার্ভা মাটি থেকে সরাসরি মানুষের পা এর মাধ্যমে বা পোষা প্রানীর
মাধ্যমে মানুষকে সংক্রমিত করে। কৃমি থাকা মাটিতে খালি পায়ে হাটা এবংকৃমি বা এর ডিম থাকা মাটিতে হওয়া ফসলের মাধ্যমেও কৃমির আক্রমণ হতে পারে।
৩. প্রাণী হতেঃ
শুধু মানুষ নয়, বিভিন্ন পোষা প্রাণি যেমন, কুকুর,বিড়াল, গরু,
ছাগল ইত্যাদির মাধ্যমেও কৃমির সংক্রমণ হতে পারে।
এছাড়াও অপরিচ্ছন্ন ঘর-বাড়ি, হাত- পায়ের নখ বড় থাকা, মলত্যাগের পর সাবান দিয়ে হাত না ধোয়া, খাবার বানানো বা খাওয়ার আগে হাত সাবান দিয়ে না ধোয়া, কাঁচা ফলমূল বা শাক-সব্জি না ধুয়ে বা যথেষ্ট রান্না না করে খাওয়া, খালি পায়ে শৌচাগারে যাওয়া এসবের ফলেও কৃমি হতে পারে।
কৃমির লক্ষণ
কৃমি হলে নিচের লক্ষণ গুলো দেখা দিতে পারেঃ
১. দুর্বলতা, মাথা ঘোরা।
২. পেটে বিশেষ করে তলপেটেব্যথা।
৩. ক্ষুধামন্দা
৪. অকারণে ক্লান্তলাগা
৫. কাশিহওয়া
৬. ডায়রিয়াওবমিহওয়া, কখনো বমির সাথে কৃমি আসতে পারে।
১৮. বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অনেক সময় কামড়ে দেয়া বা খামচে দেবার প্রবণতা বেড়ে
যাওয়া।
১৯. মুখে সবসময় থুতু আসা, ছোট বাচ্চাদের অনেক সময় থুতু দেবার প্রবণতা বেড়ে
যাওয়া।
কৃমির প্রতিকার
কৃমির কারণ ও লক্ষণ গুলি জানলাম, এখন জানব কৃমির প্রতিকার সম্পর্কে। কৃমির প্রতিকার দুই ভাবে করা যেতে পারে ভেষজ পদ্ধতিতে এবং ওষুধ প্রয়োগ করে।
প্রথমে কৃমির প্রতিকার এর ভেষজ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হলোঃ
কৃমির প্রতিকার এর ভেষজ পদ্ধতিঃ
১. কালমেঘ পাতার রসঃ
কৃমির প্রতিকার এর ভেষজ পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কালমেঘ পাতার রস। এটি কৃমির প্রতিকার বিশেষ করে শিশুদের বেলায় অত্যন্ত উপকারি।
২. মূলাঃ
৫০ মি.লি. মূলার রসের সাথে সৈন্ধব লবণ এবং গোলমরিচের গুড়ো মিশিয়ে সকাল-বিকাল খেলে কৃমির প্রতিকার হয়।
৩. রসুনঃ
সকালে দুই থেকে তিন কোয়া রসুন খেলে কৃমির প্রতিকার সম্ভব। এটি কয়েকদিন নিয়মিত খেলে কৃমি পুরোপুরি নির্মূল সম্ভব।
কৃমির প্রতিকার এর ভেষজ পদ্ধতি হিসেবে পেঁপের জুড়ি নেই। সকালে খালি পেটে এক গ্লাস দুধের সাথে এক চা চামচ মধু এবং কাঁচা পেপের রস মিশিয়ে খেতে হবে। কয়েকদিন খেলেই কৃমি মারা যাবে। এছাড়া পাকা পেঁপের বীজ গুড়া করে মধুর সাথে খাওয়া যেতে পারে।
কৃমি দূর করতে সকালে খালি পেটে এক টুকরো কাঁচা হলুদ চিবিয়ে খেয়ে দেখা যেতে পারে। এছাড়া কাচা হলুদের সাথে শসার বীজ গুড়ো করে একসাথে মিশিয়ে খেলেও কৃমি বিশেষ করে ফিতাকৃমি মারা যায়।
কৃমি দমনে মিষ্টি কুমড়ার বীজ এর সফলতা প্রমাণিত। University of Maryland Medical Center এর গবেষণায় তা দেখা গেছে। মিষ্টি কুমড়ার বীজ গুড়ো করে পানিতে সিদ্ধ করে বা মধুর সাথে মিশিয়ে খেলে কৃমি দমনে উপকার পাওয়া যায়।
৮. লবংগঃ
লবংগ তে থাকা উপাদান শুধু কৃমি নয় কৃমির ডিমও ধ্বংস করে। তাই কৃমি দূর করতে প্রতিদিন লবংগ খান।
৯. নিমঃ
কৃমি তাড়াতে সবসময়ই তিতা খাদ্যের উপর জোর দেয়া হয়। এক্ষেত্রে নিম এর জুড়ি নেই। কৃমি তাড়াতে অনেকভাবেই নিম খাওয়া যায়। যেমন, নিমপাতার রস, নিমের তেল, নিমফল, নিম বীজের গুড়ো ইত্যাদি। সকালে খালি পেটে নিমপাতা বাটা কুসুম গরম পানিতে মিশিয়ে খেলে কৃমি মারা যায়।
কৃমির প্রতিকার এর জন্য সাধারনত চিকিৎসকেরা এলবেন্ডাজল, মেবেন্ডাজল বা পাইপেরাজিন গ্রুপের ওষুধ দিয়ে থাকেন। তবে গর্ভবতি নারী, ডায়রিয়ার রোগী বা জ্বরের রোগীকে কৃমির ওষুধ দেয়া যায় না। এগুলো বিভিন্ন নামে বাজারে পাওয়া যায়। তবে সুস্থ মানুষের প্রতি তিন বা ছয় মাস পরপর একক মাত্রার কৃমিনাশক ওষুধ সেবন করা যায়। সাধারনত এক ডোজ ওষুধ সেবনের ৭ দিন পর আরেক দোজ ওষুধ খেতে হয়।
কৃমি প্রতিরোধ
কৃমি প্রতিরোধ এর জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেয়া যেতে পারেঃ
১. তিন মাস বা ছয় মাস পরপর পরিবারের সকল সদস্যদের একসাথে কৃমিনাশক ওষুধ খেতে হবে।
২. বাড়িতে পোষা প্রানী থাকলে তাদেরও নিয়মিত কৃমিনাশক ওষুধ দিতে হবে।
৫. ছোট বাচ্চাদের মাটিতে খেলাধূলা করতে দেয়া যাবে না।
৬. কাচা শাকসব্জি ভালো করে ধুয়ে খেতে হবে।
৭. মাছ,মাংস, ডিম ইত্যাদি ভালো করে ধুয়ে এবং সঠিক তাপমাত্রায় রান্না করে খেতে হবে।
৮. খাবার পূর্বে এবং টয়লেট করার পরে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
শেষ কথা । কৃমি । কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার এবং প্রতিরোধ
কৃমি অত্যন্ত মারাত্মক একটি পরজীবি। কৃমি পরিমানে বেশি হয়ে গেলে অন্ত্রে ব্লকেজ, অভ্যন্তরীন রক্তক্ষরণ, পুষ্টিহীনতা, এমনকি মারাত্মক ক্ষেত্রে স্ট্রোক বা মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মানূষের মৃত্যুও হতে পারে।এজন্য কৃমি থেকে বেচে থাকা আমদের অবশ্য কর্তব্য। আমাদের আজকের আর্টিকেল ছিলো কৃমির কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার এবং প্রতিরোধ নিয়ে । আশা করি আজকের কৃমি সংক্রান্ত আর্টিকেল পুরোটা পড়েছেন এবং নতুন অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। আমাদের এই আর্টিকেল আপনাদের কাজে লাগলে আমদের শ্রম স্বার্থক হবে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url